১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মহান বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে, সাত কোটি বাঙালির চির মুক্তির উল্লাসে যখন ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলো ত্রিশ লক্ষ স্বজন হারানোর বেদনা; ঠিক তখনই পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালানো হয়।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর, ধানমন্ডির বাড়িতে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে, গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। ১ এপ্রিল কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে তাকে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। শত ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার উষ্ণতম অঞ্চল, লায়ালপুর শহরের এক নির্জন কারাগারে বন্দি করা হয় বাঙালির এই মহানায়ককে। পরবর্তীতে উত্তর পাঞ্জাবের মিয়াওয়ালি কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য নির্ধারিত নির্জন জেলে রাখা হয় তাকে।
এমনকি বঙ্গবন্ধুর চেয়ারে পর্যন্ত ট্রান্সমিটার বসানো হয়, যাতে তার সব কথাই শুনতে পায় জান্তারা। লাগাতার মানসিক নির্যাতনের পরেও তাকে টলাতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানিরা।
এরপর, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে, এক গোপন বিচারের মাধ্যমে, তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে তারা। বঙ্গবন্ধুর নামে যে ১২টি অভিযোগ সাজানো হয়, তার ৬টির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড।
আগস্ট মাসের ২০ তারিখ, জেনারেল ইয়াহিয়া খান মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে জানান, ‘মুজিবের ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না। তার ফাঁসির আদেশ হলেও তা হয়তো শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে না। কয়েকমাস সময় নেওয়া হতে পারে।’ এই তথ্য গণমাধ্যমে আসার পরেই, বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয় পাকিস্তান সরকারকে।
তবুও থেমে থাকেনি পাকিস্তানি জান্তারা।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে, গোপন সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। এরপর মিয়াওয়ালি কারাগারে তার জেলের সামনে কবর খোঁড়ে সেনারা।
তবে বাংলার রণাঙ্গণের পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। অন্যদিকে নির্বাচনে বিজয়ী নেতা শেখ মুজিবকে হত্যা করার ব্যাপারে পাকিস্তানকে সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা দেয় জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো।
তখন মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নের পথ বদল করে, জেলের মধ্যে থাকা খুনি আসামিদের দিয়ে হাঙ্গামা বাধিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সর্বশেষ পরিকল্পনা করে পাকিস্তানিরা।
এদিকে, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, জান্তাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়াকে সরিয়ে পাকিস্তানের দায়িত্ব নেয় জুলফিকার আলী ভুট্টো। তখনও ইয়াহিয়া তাকে অনুরোধ করেছিল যে- শেখ মুজিবকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে, মৃত্যুর দিন হিসেবে পুরনো একটা তারিখের ঘোষণা দিতে।
কিন্তু, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ এবং ৯৩ হাজার বন্দি পাকিস্তানি সেনার ভাগ্যের কথা চিন্তা করে, ইয়াহিয়ার পরামর্শ বাস্তবায়নের সাহস পায়নি ভুট্টো।
অবশেষে, ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখে আনন্দঅশ্রুতে ভেঙে পড়েন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায় বাঙালি জাতির মহান স্বাধীনতা।